১.ফরায়েজী আন্দোলন কী ? এই আন্দোলনের লক্ষ্য ও প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তর ঃ-
ভূমিকা ঃ- ভারত বর্ষের মুসলমানদের পুর্নজাগরণের ক্ষেত্রে যে কয়টি সংস্কার আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় স’ায়ী আসন লাভ করতে সমর্থ হয়েছে ফরায়েজী আন্দোলন তাদের মধ্যে অন্যতম। ধর্মীয় সংস্কার সাধন ছিল এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। কিন’ পরবর্তীতে বাস-বতার নির্মম কর্ষাঘাতের ঘটনার অনিবার্য পরিণতিতে এই আন্দোলনের রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।
আন্দোলনের প্রবক্তা ঃ-
ফরায়েজী আন্দোলনের মূল প্রবক্তা ছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহ।তিনি ১৭৮১ সালে ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। বাল্যকাল থেকে তিনি চিন-াশীল, মনোযোগী ও অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি মক্কা শরীফে যান। দীর্ঘ কুড়ি বছরের মত সেখানে অবস’ান করে ইসলামী শিক্ষা আয়ত্ত করেন। মক্কা শরীফে অবস’ানকালে তিনি ওয়াহাবী আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন এবং এই আন্দোলন দ্বারা গভীরভাবে উদ্ধুগ্ধ হন। ১৮১৮ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে বিখ্যাত ভারতীয় চিন-াবিদ শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ ও বিপ্লবী সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হন এবং সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৮৪০ সালে এই মহৎপ্রাণ ও ধার্মীক নেতা মৃত্যুবরণ করেন।
ফরায়েজী আন্দোলন ঃ ফরজ শব্দ থেকে ফরায়েজী শব্দটি এসেছে। হাজী শরীয়তউল্লাহ এই সময়ে মুসলমান সমাজের বিভিন্ন অনৈসলামিক কাজকর্ম লক্ষ্য করে মুসলমানদের কে ইসলামের নির্দেশিত পথে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলায় যে আত্নশুদ্ধির আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন ইতিহাসে তা ফরায়েজী আন্দোলন নামে পরিচিত।
১৮০০ সালে হাজী শরীয়তউল্লাহ এর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র মোহাম্মদ মুহসীন (দুদু মিয়া) এই আন্দোলনের নেতৃত্বভার বহন করেছিলেন।
ফরায়েজী আন্দোলনের লক্ষ্য ঃ এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল দুটি। নিম্নে তা উপস’াপন করা হল ।
(ক) কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা দূরীকরণ ঃ ফরায়েজী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের স্বচ্ছ ও ধর্মীয় জ্ঞান দান করা এবং উদার দৃষ্ঠিভঙ্গি গড়ে তোলা। যেসব ধর্মীয় কুসংস্কার ও প্রথা মুসলমানদের সমাজ জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তিনি সেগুলোর বিরুদ্ধে এক আন্দোলন গড়ে তোলেন। কবর পূজা, পীর পূজা, মহররমের শোক পালন করা ইত্যাদি বিভিন্ন অনৈসলামিক কাজকর্ম যা সমাজ ব্যবসথাকে দূর্বিষহ করে তুলেছিল। মুসলমানদেরকে সে সব কাজ বাদ দিয়ে ফরজ কাজে উদ্ধুগ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি মহান প্রয়াস চালান।
(খ) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিঅর্জন ঃ এই আন্দোলনের অপর লক্ষ্য ছিল মুসলমান সমাজকে শুদ্ধ ধর্মীয় বিস্বাসে উদ্ধুগ্ধ করে ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। হাজী শরীয়তউল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন ভারত বর্ষ থেকে ইংরেজ শাসকদের বিতাড়িত করা ব্যতীত এই উপমহাদেশের জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তাই তিনি দরিদ্র প্রজাদের ব্যবসায়ী মহাজন নীলকর ও জমিদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বৃটিশ অধিকৃত এ দেশকে ‘দারুল হারব’ বা বিধর্মী বাক্য বলে ঘোষনা করেন। ইংরেজ সরকার ও হিন্দু জমিদার শ্রেণীর শত বিরোধিতা সত্বেও তিনি ছিলেন অনড়,অবিচল ও নির্ভীক। যা মুসলমান সমাজকে আত্নবিস্বাসী করে তুলেছিল।
ফরায়েজী আন্দোলনের তাৎপর্য ঃ ফরায়েজী আন্দোলনের লক্ষ্য ও প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই আন্দোলন তৎকালীন অখন্ড বাংলার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমান সমাজে ব্যপক প্রভাব বিস-ার করেছিল।
নিম্নে তা আলোচনা করা হল ঃ
র. এই আন্দোলন বাংলার মুসলমানদের পূর্ণ জাগরণী সঞ্চার করে।
রর. এই আন্দোলন মুসলমানদেরকে ইসলামের নির্দেশিত পথে চলার অনুপ্রেরণা যোগায়।
ররর. এই আন্দোলন মুসলমানদেরকে তাদের হারানো গৌরব পুনুরুদ্ধারের স্বপ্নে উজ্জীবিত করে।
রা. এই আন্দোলন প্রমান করে, হিন্দু জমিদার ও বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী উভয়ই হচ্ছে মুসরমানদের শত্রু
া. এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার মুসলমানদের মাঝে ঐক্যবদ্ধের চেতনা দানা বেধে উঠতে থাকে।
ার. এই আন্দোলন মুসলমানদের সাংগঠনিক শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
ারর. এই আন্দোলনের মাঝে বাংলার ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস’া কায়েমের স্বপ্ন অন-র্নিহিত ছিল।
াররর. ফরায়েজী আন্দোলন হিন্দু জমিদার ও নীলকদের ক্ষমতার ভিতকে কাপিঁয়ে দিয়েছিল।
রী. এই আন্দোলন সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বলা যায়, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের আন্দোলন সমূহে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহনের সূত্রপাত ঘটে।
উপসংহার ঃ ফরায়েজী আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মীয় আচরণের একটি সংস্কার আন্দোলন । কিন’ শক্তিশালী জমিদার, নীলকদের প্রবল আক্রমনের মুখে এই আন্দোলন অবশেষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও বলা যায় যে, মুসলমানদের আত্নবিশ্বাস জাগ্রত করতে, কৃষকদের প্রতিবাদমুখর করতে এবং জাতীয় চেতনায় উদ্ধুগ্ধ করতে ফরায়েজী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।