***ভারত কেন ভাঙ্গলো?
মনসুর আহমদ : ভারতবর্ষের ইতিহাস বড় দীর্ঘ। খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে মুসলমানগণ ভারতবর্ষে প্রথম প্রবেশাধিকার লাভ করে। খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতবর্ষ ভারতবর্ষের নৃপতিগণ কর্তৃক শাসিত ও রক্ষিত হয়। মুসলমানগণের ভারতাগমন সময় হতে ভারতবর্ষে বৈদেশিকগণের আধিপত্য। মোঘল শাসকগণ ভারতবর্ষে প্রায় আট শত বছর শাসন করে। “ হিন্দু, মুসলিম শাসনকে কখনও অন্তর থেকে গ্রহণ করেনি, বরাবর অপরিত্যাজ্য অপ্রতিরোধ্য পাপ হিসাবে দেখেছে এ জন্য যতো দিন ‘অস্পৃশ্য বিদেশী ম্লেচ্ছের’ ক্ষাত্রশক্তি প্রবল ও নিরঙ্কুশ থেকেছে, ততদিন অবাঞ্ছিত পাপ হিসাবেই সহ্য করেছে। .. বাহাদুর শাহের পর প্রতীক্ষারত নেকড়ের, মতো দুর্বল মুঘল রাজশক্তির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে “ হিন্দু পাদ-পাতশাহী প্রতিষ্ঠা কল্পনায় মত্ত হয়ে উঠেছে।”
কিন্তু তাদের হিন্দু পাদ- পাতশাহী প্রতিষ্ঠার সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় নি। এক সময় এই শাসন ভার চলে যায় ইংরেজদের হাতে। আর হিন্দু সমাজ ভারতে ইংরেজ শাসনকে ভগবানের আশীর্বাদ রূপে গ্রহণ করেছিল। মুসলমানদের শাসন যাতে কায়েম না হয় এটাই ছিল হিন্দুদের ইচ্ছা। শ্রী রতন লাল চক্রবর্তী তার “ফকীর সন্ন্যাসী বিদ্রোহ” নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, “ফকিরদের সংগ্রাম ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা পুনঃরুদ্ধার করা। সন্ন্যাসীরা কখনো ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি বা স্বাধীনতা পুনঃরুদ্ধারের কোন কল্পনা তাদের ছিল না । বরং তাদের সংগ্রাম ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের শাসন যাতে আবার কায়েম না হয় সে জন্য তারা ইংরেজদের সহায়তা করেছিল।” (রতন লাল চক্রবর্তী- ফকীর ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ)
বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় সে সময় ব্রিটিশের বিরোধিতার পরিবর্তে চরম তোষণ নীতি বেছে নিয়েছিল। এ ব্যাপারে বহু প্রমাণ রয়েছে। প্রমাণ হিসাবে উদাহরণ স্বরূপ ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার ২-৭-১৮৫৮ খ্রিঃ হিন্দুদের রাজভক্তি শিরোনামে সম্পাদিকীয়টির কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হল। “শ্রীযুক্ত কেদার নাথবাবু বিদ্যোৎসাহী নব যুবক ব্যক্তি। তিনি ‘হিন্দু জাতির রাজভক্তি’ নামক এক খানি অভিনব গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন। আমরা উক্ত গ্রন্থ পাঠ করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। যেহেতু যথার্থ পক্ষে এই পুস্তক নিজ নামের অর্থ প্রকাশ করিতেছে। রাজভক্ত প্রজাগণ এই গ্রন্থ পাঠ করিলে পর তাহাদিগের অন্তরে স্বরূপ রাজভক্তি উদ্দীপিত হইবে সন্দেহ কি? অনুরোধ করি এই পুস্তক ক্রয় করতঃ আপনারা রাজভক্তি বিষয়ে সদুপদেশ গ্রহণ করুন এবং গ্রন্থ কর্তাকে সমুচিত উৎসাহ দিন। অধিকন্তু উক্ত গ্রন্থ সমগ্ররূপে প্রচারিত হইলে পর প্রজাগণের প্রতি ও সবিশেষ রাজানুগ্রহ প্রকাশ পাইবে তাহাতে সন্দেহ নাই।”
এখানেই শেষ নয়, বর্ণহিন্দুদের দাবির নিকট নতি স্বীকার করে ১৯১১ সালের ১১ই ডিসেম্বর স¤্রাট পঞ্চম জর্জ ও রাণী মেরীর দিল্লীর দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ করেন। এতে আনন্দে উল্লাসিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পঞ্চম জর্জের প্রশংসায় রচনা করেন “জনগণ মন অধিনায়ক হে ভারত ভাগ্য বিধাতা . . . .” গানটি। প্রভুদের এমন স্তুতিতে তারা কি খুশি না হয়ে পারে?
বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী হিন্দুদের কল্যাণে এগিয়ে এসে ছিল গোড়া থেকেই। হিন্দুদের পক্ষে কল্যাণের প্রথম পদক্ষেপ ছিল তাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণ ওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার মৌল উদ্দেশ্যই ছিল অধস্তন হিন্দু অফিসারদের জমির মালিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। এই বন্দোবস্ত প্রথা চালু হওয়ার ফলে “যে সব হিন্দু কর আদায়কারী ঔ সময় পর্যন্ত নি¤œ পদের চাকরিতে নিযুক্ত ছিল, নয়া ব্যবস্থার বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয়। নয়া ব্যবস্থা তাদেরকে জমির উপর মালিকানার অধিকার এবং সম্পদ আহরণের সুযোগ সুবিধা প্রদান করে, অথচ মুসলমানরা নিজেদের শাসনামলে এই সুযোগ সুবিধাগুলোই একচেটিয়া ভাবে ভোগ করছে।” বৃটিশদের এমন চক্রান্তই ভারত ভাঙ্গার পেছনে পরবর্তীতে অন্যতম চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করেছে।
চাকরির ক্ষেত্রে বাংলায় মুসলমানদের অবস্থা ছিল বড়ই করুণ। কয়েকটি বিভাগে ১৯৬৯ সালে চাকরির আনুপাতিক হার দেখলেই অনুভব করা সম্ভব কিভাবে মুসলমানদের সব জায়গায় কোনঠাসা করে রাখা হয়েছিল। এ্যাসিস্টান্ট গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারের তিনটি গ্রেডে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ১৪ জন, মুসলমান একজনও নয়; শিক্ষানবিশী পর্যায়ে হিন্দু চার ও ইংরেজ দুই জন, কিন্তু মুসলমান একজনও নয়। সাব ইঞ্জিনিয়ার গণপূর্ত বিভাগের সুপার ভাইজার পদে হিন্দু ২৪ জন আর মুসলমান একজন; ওভারসিয়ার পদে মুসলমান দুই জন আর হিন্দু তেষট্টি জন। এ্যাকাউন্টস অফিসার পদে হিন্দু পঞ্চাশ জন কিন্তু মুসলমান এক জনও নয়; এবং আপার সাবর্ডিনেট ডিপার্টমেন্টে হিন্দু বাইশ জন; কিন্তু মুসলমানের সংখ্যা শুন্যের কোঠায়। (দি ইন্ডিয়ান মুসলমান)
এ রকম হওয়ার কারণ এটা ছিল না যে মুসলমানদের চাইতে হিন্দুরা অধিকতর যোগ্য ছিল। বরং অন্যায় ভাবে উচ্চস্তরের বা নি¤œ স্তরের সমস্ত চাকরি ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এ ভাবে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের উপরে যে উপেক্ষা ও অপমানজনক ব্যবহার প্রদর্শিত হয়েছিল, আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যে তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মুসলমানদের প্রতি এই অপমানজনক আচরণ হিন্দু থেকে আলাদা হবার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
ভারতীয়দের আগা গোড়া চক্রান্ত ছিল ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদেরকে তাদের নিজস্ব জীবন বোধ ও জীবনাচার থেকে দূরে রাখা। ১৮৮৭ সালের মাদ্রাজে যে কংগ্রেস অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় সে সভাতে লালা লাজপত রায় বলেছিলেন, মুসলমানরা এখানে বহিরাগত । তারা যদি হিন্দুদের আচার বিধি পালন না করে তবে ভারতে তাদের বসবাস করতে দেয়া উচিত নয়। বৈদিক ধর্মের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল আর্য সমাজের উদ্দেশ্য। আমরা দেখি ১৯৩৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল যুক্ত প্রদেশের আইন সভায় প্রদত্ত ভাষণে প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রী মিঃ সম্পরনানন্দ বলেন, “হিন্দু কিংবা মুসলিম সভ্যতাকে কায়েম রাখা এবং তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে চালু করার জন্য যিনিই পীড়াপীড়ি করেন, তিনি নিশ্চত ভাবে ভারতের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত। আমরা বলতে চাই যে, আজকের ভারতে এ উপসর্গটা না থাকাই বাঞ্ছনীয়। আমরা এমন একটা ভারতীয় সভ্যতা চাই, যা হিন্দু, মুসলমান, অন্য ধর্মাবলম্বী এবং যে কোন বহিরাগত – যে ভারতকে নিজের আবাস ভূমি করে ’ নিয়েছে, -এ সকলের জন্যই এক ও অভিন্ন।” হিন্দু মুসলমান সবকে এক দেহে লীন করার হিন্দু ষড়যন্ত্র ছিল ভারত ভঙ্গের আর একটি কারণ।
ভারত কেন ভাঙ্গলো? আমাদের ভারত থেকে আলাদা হওয়ার কারণটা কী ছিলো? “কারণটা বোঝা যাবে ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার ’ নামে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধ থেকে। ..একটি উদ্ধৃতি অত্যন্ত প্রাণিধান যোগ্য। উদ্ধৃতিটি তারাকৃষ্ণের ‘রাজভক্তিবিষয়ক’ প্রবন্ধ থেকে।“ পূর্ব্বকালে যখন এই দেশ হিন্দু জাতির শাসনাধীনে ছিল তখন রাজাগণের পক্ষপাতিতা দোষে জাতি বিশেষ অপর সমস্ত জাতির উপর সম্পূর্ণ প্রভুত্ব করিতেন, ঐ সকল জাতিকে স্বর্গ বা নরকগামী করণের কর্তা ছিলেন। .. .. .. যখন এই রাজ্য যবনদিগের হস্তে ছিল, তখন তাহারা হিন্দু বর্গকে নাস্তিক ও অধার্মিকের শেষ বলিয়া নির্দেশ করিয়া ছিলেন। স্বজাতি প্রজাবর্গের প্রতি যাবতীয় বিষয়ে অনুগ্রহ, হিন্দু প্রজাদিগের প্রতি সর্বতো ভাবে নিগ্রহ করিতেন।.. .. ব্রিটিস জাতির রাজনিয়মাবলীতে এই সকল দোষের লেশও নাই, তাহারা আপন জাতীয় এবং এদেশস্থ ডোমপ্রভৃতি যৎপরোনাস্তি নীচ ব্যক্তিকে বিচার কালে সমান দেখিতেন। .. .. ঐ জাতির পক্ষপাত শূন্যতা গূণের অধিক প্রশংসা কী করিব?”
এ সব উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্টত উপলদ্ধি করতে পারা যায়, ইতিহাসের ঘাতপ্রতিঘাতে এ দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর চেতনা এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর চেতনার মধ্যে একটি বিরাট পার্থক্য ও ভেদ রেখার সৃষ্টি হয়েছিল। পার্থক্যের চেতনা বোধ এমন ভয়ানক অবস্থায় পৌঁছে গেল। হিন্দুদের মনের কথা জ্ঞানেন্দ্র পা-ে তার বইতে তুলে ধরতে গিয়ে লিখলেন, “ .. যদি মুসলিমরা এই দেশে থাকতে চায়, তা হলে আমাদের মত করে থাকতে হবে। “.. হিন্দুস্তান মে র্যাহনে হায় তো হামসে মিল কর রাহনে হোগা। হিন্দুস্তানমে র্যাহনে হায় তো বন্দে মাতরম কাহনে হোগা।” এ সব থেকে প্রমাণিত হয় যে হিন্দু মানসের মধ্যে একটা চিন্তা কাজ করছিল, সেই চিন্তাটা হচ্ছে- যদি মুসলমানরা ভারতবর্ষে থাকতে চায়, তা হলে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ত্যাগ করে তাদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে হবে তাদেরকে বন্দে মাতরম বলতে হবে। এ চিন্তা মুসলমানদের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য ছিল না। সে কারণে মুহম্মাদ আলী জিন্নাহ স্পষ্ট বলে ছিলেন “.. .. Our outlook is not only Fundamentally different but often radically antagonistic to the Hindus. We are differebt beings, There is nothing in life which links us together,”
মুসলমানদেরকে তাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও জীবন বোধসহ ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ নিয়ে অখ- ভারত ভূমিতে বাস করা অসম্ভব হবে ভেবে মুসলমানদের মনে স্বতন্ত্র আবাস ভূমির চিন্তা জাগ্রত হয়। এ সত্যের আভাস দিয়ে ছিলেন আল্লামা ইকবাল ১৯৩০ সালে লক্ষেèৗতে অনুষ্ঠিত সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ অধিবেশনে।
এ সব ছাড়াও ভারত ভাঙ্গার দৃশ্যমান বড় কারণ বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগের প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে বাঙ্গলা প্রদেশটি বিভক্তি করণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। লর্ড কার্জনের দায়িত্বভার গ্রহণের পূর্বে বঙ্গ বিভাগের প্রস্তাবাবলী পেশ করা হয়। ১৯০৩ সালে সরকারী গেজেটে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রকাশিত হয়। বঙ্গ বিভাগ কার্যকরী করা হয় ১৩ই অক্টোবর ১৯০৫ সালে। বঙ্গ ভঙ্গের ফলে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে আনন্দের বান ডেকেছিল। কিন্তু বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় এ ব্যবস্থাকে তাদের কায়েমী স্বার্থের মূলে কুঠারাঘাত বিবেচনা করে বঙ্গ বিভাগের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। স্বার্থবাদী বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গ বঙ্গ রদের জন্য দেশব্যাপী প্রবল আন্দোলন শুরু করে, এমন কি হিংসাত্মক কার্যক্রমের আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৯১২ সালের ২ মে ডিসেম্বর বাংলা বিভাগ রদ ঘোষিত হলে মুসলমান মধ্য বিত্ত সম্প্রদায় ব্রিটিশ বিদ্বেষী হয়ে ওঠে।
এ সময় হিন্দু মুসলমান সম্বন্ধটা আরও তিক্ত হয়ে পড়ে। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান মুসলমানদেরকে শংকিত করে তোলে এবং তারা তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা ও তার অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯০৬ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ছিল এদেশের রাজনৈতিক গগনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পরে কংগ্রেস চিহ্নিত হয়ে গেল হিন্দুদের, এবং মুসলিম লীগ চিহ্নিত হল মুসলমানদের শ্রেণীবদ্ধ হওয়ার মিলন ক্ষেত্র।
কংগ্রেসী হিন্দুরা মুসলিম লীগকে কখনও প্রীতির চক্ষে দেখেনি। তার জন্মলগ্ন থেকে হিন্দুরা সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল। মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি ও ১৯০৯ সালে সে দাবির পূরণ হিন্দুদের আরও বিভ্রান্ত করে। ১৯১০ সালে নাগপুর সম্মেলনে কংগ্রেসের মুসলমান সভাপতি সৈয়দ নবীউল্লাহ দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করেন, এবং ১৯১১ সালে উভয় দলীয় নেতাদের এক বৈঠক হয়। কিন্তু কোন ফল হয়নি।
১৯১৫ সালে ৩০ ডিসেম্বর বোম্বে শহরে মুসলিম লীগের অষ্টম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের অধিবেশনও এ সময় বোম্বে শহরেই অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের সভাপতি এস,পি সিংহ ও লীগের সভাপতি মাজহারুল হক তাঁদের ভাষণে হিন্দু মুসলিম ঐক্য ও সহযোগিতার উপরে জোর দেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ও ৩ শে ডিসেম্বর কংগ্রেস ও লীগের বার্ষিক অধিবেশন লক্ষেèৗতে অনুষ্ঠিত হয় ; এ সময় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে একটি চুক্তি হয় যা লক্ষেèৗ -চুক্তি নামে অভিহিত ।
লক্ষেèৗ- চুক্তিতে কংগ্রেস ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লো মিন্টো আইনে অর্জিত মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথা ও আইন সভাগুলোতে আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থার দাবি মেনে নেয় এবংপরোক্ষ ভাবে পাকিস্তান আন্দেলনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। পৃথক নির্বাচন হিন্দুদেরকে বিচলিত করে তোলে। এ সময় দয়ানন্দ সুরস্বতী শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করে। তার প্রেক্ষাপটে কোহাট, লক্ষেèৗ, এলাহাবাদ ও কলকাতাসহ বহু স্থানে সাম্প্রদায়িক দাংগা শুরু হয়। ১৯২৩ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত এ রকম মারাত্মক দাংগার সংখ্যা ১১২টি।
লক্ষেèৗ- চুক্তির পরে রাজনৈতিক গতিধারা দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯১৮ সালে প্রথম মহা যুদ্ধের অবসান হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ক হেরে গেলে ভারতীয় মুসলমানগণ ওসমানিয়া খিলাফতের অস্তিত্ব সম্পর্কে শংকিত হয়ে পড়ে এবং বৃটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। খিলাফতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মৌলানা মুহম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন নামে মুসলমানদের সরকারবিরোধী এক শক্তিশালী আন্দোলন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে ১৪ই নভেম্বর ফজলুল হকের সভাপতিত্বে খিলাফত বৈঠকের প্রথম অধিবেশন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে
তুরস্কের অখ-তা ও খলিফার মর্যাদা রক্ষার দাবি করা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এ বিষয়ে বৃটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি না পেলে মুসলমানগণ সরকারের সঙ্গে অসহযোগ নীতি অনুসরণ করে চলবে। বেশ কয়েকজন কংগ্রেসী নেতা এ বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন এবং গান্ধী একটি বিশেষ সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। তিনি খেলাফতের বিষয়ে কংগ্রেসের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। গান্ধী এ সময় কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করেন। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের ফলে সর্বভারতীয় প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। অবশ্য খিলাফত আন্দোলন কালে হিন্দু মুসলমান একত্রে গণআন্দোলন চালালেও মনের মিল হয়নি।
রাজনীতিক ও ধর্মীয় নানা ক্ষুদ্র প্রশ্নের সমাধানে গোঁড়া নীতি অনুসরণের ফলে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কে ফাটল ধরে। ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলাদেশের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে বেঙ্গলপ্যাক্ট সম্পাদনের চেষ্টা করেন। কিন্তু কংগ্রেসের অনমনীয় মনোভাবে এ চুক্তি ফলবতী হয়নি।
হিন্দু-মুসলমানের মিলন প্রচেষ্টা চিরতরে ব্যর্থ হয় নেহেরু রিপোর্টের কারণে। ১৯২৮ সালে এদেশের শাসন ব্যবস্থা সংস্কার সম্বন্ধে বিবেচনা করার জন্য সাইমন কমিশন এসে ছিল। কংগ্রেস কমিটি বয়কট করলো। এ বছর দিল্লীতে এক সর্বদলীয় সম্মেলন আহুত হল দেশের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য, এবং মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে একটি সাব কমিটি গঠিত হলো শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের জন্য। কিন্তু নেহেরু রিপোর্ট যখন প্রকাশিত হলো, দেখা গেল স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থাই অস্বীকৃত হয়েছে, এবং বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলমানের সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া হয়েছে। গান্ধী প্রকাশ্যে নেহেরু রিপোর্টের প্রশংসা করেন এবং এ রকম রিপোর্ট প্রণয়নের জন্য মতিলাল নেহেরুকে টেলিগ্রাম যোগে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। এতে মিলনকামী মুসলিম নেতারা হতবুদ্ধি হলেন এবং হিন্দু মুসলিম মিলন প্রচেষ্টা নেহেরু রিপোর্ট দ্বারা চিরসমাধি লাভ করলো। রিপোর্টের সংশোধনী হিসাবে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর চৌদ্দ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু জিন্নাহর সংশোধনী প্রস্তাব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন বর্ণহিন্দু প্রধান কংগ্রেস গ্রাহ্য করেনি।
সকল সম্প্রদায়ের অধিকার, দেশীয় রাজাদের মর্যাদা ও বৃটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে বৃটিশ সরকার ১৯৩৫ সালে ভারত আইন প্রণয়ন করে। ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন বাংলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। বাহ্যতঃ এই নির্বাচন যুদ্ধে মুসলিম লীগ ৩৮টি আসন পায় এবং ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি পায় ৩৯ টি আসন। পাঞ্জাব, সিন্ধ ুও সীমান্ত প্রদেশে বাংলার মতো মুসলিম লীগের সাফল্য সম্ভব হয়নি। এই নির্বাচনের ফলে পরিষদে কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০ এবং মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির সদস্য সংখ্যা যথাক্রমে ৫৯ ও ৫৫ জন।
১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ২৯৫ মিলিয়ন ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করে যাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ ছিল মুসলমানের ভোট। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলিম লীগের প্রার্থীরা মুসলিম ভোটের মাত্র শতকরা ৫ ভাগ ভোট পায়। এমন বিরাট বিজয় অর্জনের পরে ১৯৩৭ সালের মার্চের গোড়ার দিকে মিঃ নেহেরু বললেন, There were only two parties in the country- Congress and the British প্রতি উত্তরে মিঃ জিন্ন্াহ বললেন, There is a third party..the Muslims.” ”
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস আটটি প্রদেশে সরকার গঠন করে, যার ফলে হিন্দু জাতীয়তা উগ্ররূপ ধারণ করে। Sir Percival Griffiths বলেন,The Congress High Command refused to sanction Congress- League coalitions and in the Hindu majority provinces ministries consisting only of Congress were formed,”
কংগ্রেস হিন্দু সংখ্যাগুরু প্রদেশে এমন শাসন পদ্ধতি অবলম্বন করে যে মুসলমানদেরকে কার্যকর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ উভয় কাজ থেকে বেদখল করে দেয়া হয়। কংগ্রেস তার নয়া শাসনতান্ত্রিক সংস্কার দ্বারা যে কর্মপন্থা অবলম্বন করে, তার একমাত্র অনিবার্য ফল এই ছিল যে, এই শাসনতন্ত্রের কল্যাণে যতটুকু রাজনৈতিক শক্তি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে ভারতের কাছে হস্তান্তরিত হবে তা হিন্দুদের কুক্ষিগত হবে। যেখানে মুসলিম সংখ্যালঘু, সেখানেতো তারা সরাসরি হিন্দু সংখ্যাগুরুর শাসনাধীন হবে। কংগ্রেসী প্রাদেশিক সরকারগুলো সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির নির্দেশে শাসন চালাতে থাকে।
কংগ্রেস ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে নতুন ভারতের কাজ যে মডেলে আরম্ভ করেছিল তাতে মুসলমানদের জাতীয়তা ও কৃষ্টির কোন স্থান ছিল না। বরদা পরিকল্পনা, বিদ্যামন্দির পরিকল্পনা তার সুস্পষ্ট উদাহরণ। এমনিভাবে ১৯৩৭ সালের কংগ্রেস সরকারের মুসলমান দলন ও হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার বা¯তব চিত্র দেখে মুসলমানেরা পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি সাধনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। কংগ্রেসের বঙ্গ ভঙ্গ রোধ আন্দোলন ও পরবর্তীতে মুসলমানদের সাথে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনোত্তর আচরণ মুসলমানদেরকে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য অনুপ্রাণিত করে। ১৯৩৭ সালে জিন্নাহ বলেছিলেন,“বৃটিশরা যদি ভারত ছেড়ে চলে যায়, আর এই এলাকা যদি পাকিস্তান না হয় তা হলে হিন্দুরা কোনক্রমেই আমাদের এমন কোন আইন করতে দেবে না, যার ফলে নিষ্ঠুর জমিদার কুবেরের হাত থেকে মুসলমানদের আমরা মুক্ত করতে পারব। অতএব পাকিস্তান আমাদের চাই-ই-চাই। ”
এ নির্বাচন পূর্ব ও উত্তর কালের কংগ্রেসী আচরণ মুসলমানদেরকে আশাহত করে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কতগুলি ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি। তারা যুক্ত প্রদেশ, বোম্বে ও মাদ্রাজ প্রভৃতি প্রদেশে নির্বাচন মৈত্রী অনুযায়ী এ সমস্ত প্রদেশের মন্ত্রীত্ব গ্রহণকালে লীগের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করে। নির্বাচনের আগে ও পরে এই দুই নীতিকে জিন্নাহ হিন্দুদের বিশ্বাস ভঙ্গ মনে করেন এবং হিন্দু – মুসলিম ঐক্যে আজীবন বিশ্বাসী জিন্নাহ কংগ্রেসের উপর আস্থা হারান।
১৯৩৯ সাল থেকে হিন্দু – মুসলিম বিরোধ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। হিন্দু প্রধান কংগ্রেস ভারতে বসবাসকারী হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি এক জাতি এ ধূয়া তুলে সমগ্র বৃটিশ ভারতে বর্ণ হিন্দুদের প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে। এমন এক প্রেক্ষাপটে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৯ সালে তাঁর দ্বি-জাতি তত্ত ¡ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, We maintain that Muslims and Hindus are two major nations by any definition or test as a nation. . . By all the canons of international law, We are a nation.- ” জাতীয়তাবাদ নির্ধারণে যে কোন সূত্রই প্রয়োগ করা হোক না কেন হিন্দু এবং মুসলিম দু’টি জাতি। আমরা দশ কোটি লোকের এক জাতি আমাদের কৃষ্টি এবং সভ্যতা, ভাষা এবং সাহিত্য, শিল্প এবং স্থাপত্য, নাম এবং নিশানা, মূল্যবোধ এবং এর পরিমাপ, আইন এবং নৈতিকতা, প্রথা এবং পঞ্জিকা, ইতিহাস এবং ঐতিহ্য, মননশীলতা এবং অভিলাষ, সংক্ষেপে আমাদের জীবনবোধ এবং দৃষ্টিভংগি স্বতন্ত্র। আন্তর্জাতিক আইনের যে কোন বিধান অনুযায়ী আমরা একটি জাতি।” জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব সম্পর্কিত বক্তব্য অতি দ্রুত ভারতীয় মুসলমানের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। অতঃপর ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। এবং মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান হয়। এ কে ফজলুল হক প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন। লাহোর প্রস্তাবের পর রাজনৈতিক গতিধারা দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। একই বছর ভাইসরয় কংগ্রেসকে জানিয়ে দেন যে, ক্ষমতা পেতে হলে তাদেরকে মুসলিম লীগের সাথে সমঝোতায় আসতে হবে।
পূর্ব রণাঙ্গনে বৃটিশের বিপর্যয় ঘটলে বৃটিশ সরকার ভারতীয়দের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করে। এ সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার স্ট্যাাফোর্ট ক্রীপসকে একটি শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা সহ ভারতে পাঠান। কিন্তু ক্রীপস প্রস্তাব বিভিন্ন কারণে কংগ্রেস ও লীগের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি। কংগ্রেস অখ- ভারত নীতিতে অটল থাকে। অপরদিকে মুসলিম লীগও লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে অটল থাকে। ক্রীপস প্রস্তাবে কংগ্রেসের দাবি স্বীকৃত না হওয়ায় সারাদেশে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু হয়। মুহম্মদ অলী জিন্নাহ মুসলমানদেরকে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে বললেন। তাঁর দাবি ছিল ‘ প্রথমে ভারত বিভক্ত কর, পরে ভারত ছাড়।’
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে শ্রমিক দলের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। শ্রমিক দল ভারতের স্বাধীনতা দানের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিল। নতুন প্রধানমন্ত্রী এ্যাটলী ১৯৪৬ সালে ও জানুয়ারীতে ভারতে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা করেন। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ফল ঘোষিত হলে দেখা যায় বাংলার মুসলমান ভোটারগণ পাকিস্তানের দাবিতে তাদের স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী কাজ হবে বলে সিমলা কনফারেন্সে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সে সূত্র অনুসারে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে শ্রমিক দল কেবিনেট মিশন নামে একটি প্রতিনিধি দল ভারতে পাঠান। বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও লীগ প্রধান সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের দাবি সম্পর্কে কেবিনেট মিশনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা বলেন। তিনি কেবিনেট মিশনকে পাকিস্তানের দাবি মেনে নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের আহ্বান জানান।
কংগ্রেস ও লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দীর্র্ঘ আলোচনার পর কেবিনেট মিশন তাদের প্রস্তাবিত শাসনতস্ত্র ঘোষণা করেন। কেবিনেট মিশনের তিনটি প্রস্তাবের মধ্যে অন্যতম প্রস্তাব ছিল কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্র্তী সরকার গঠিত হবে। লীগ কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করায় কংগ্রেস কার্য নির্বাহী কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে। তারা স্বাধীন অখ- ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য প্রস্তাবিত গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করলে বড় লাট তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন এবং মুসলিম লীগকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে দেন নি। ১৯৪৬ সালে ৬ই আগষ্ট লর্ড ওয়াভেল নেহেরুকে অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। নেহেরু কিছু শর্তে ৫ জন মুসলিম লীগ সদস্যকে অন্তর্বর্তী কালীন সরকারে নিতে রাজি হন। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ শর্ত গ্রহণ করেন নি। ইতিমধ্যে ১৬ই আগষ্ট মুসলমানগণ ভারতের সর্বত্র হরতাল ও সভার আয়োজন করে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করে। কলকাতার গড়ের মাঠে এ দিন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে এক বিরাট সভার আয়োজন করা হয়। সভা আরম্ভ হওয়ার আগেই কলকাতার স্থানে স্থানে দাঙ্গা শুরু হয়। এই দাঙ্গায় কলকাতায় ভয়ঙ্কর গণহত্যা ও ধ্বংসকা-ের বিবরণ দিয়ে ষ্টিফেনস লিখেন, “শ্যাম পুকুর ও পার্শ¦বর্তী অঞ্চলে মানুষের মৃতদেহের স্তুপ নিকটবর্তী বাড়িগুলোর দোতলার মেঝ বরাবর উচুঁ হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় সংবাদপত্রের মতে প্রায় ৫০,০০০ লোক হতাহত হয়েছিল। মেননের মতে, ৫০০০ নিহত ও ১৫০০০ আহত হয়েছিল । ষ্টেটসম্যানের হিসাব অনুযায়ী হতাহতের সংখ্যা ২০ হাজারের কিছু বেশি ছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ সময় বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, কংগ্রেস তাঁর মন্ত্রীসভার পতনের জন্য এ দাঙ্গা বাঁধিয়েছিল। ১৯২৪ সালের ২৪শে জুন প-িত নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। মুসলিম লীগ প্রথমে এ সরকারে যোগ দিতে অস্বীকার করলেও মুসলমানদে স্বার্র্থ বিবেচনা করে লীগ সদস্যগণ এ সরকারে যোগ দেন। এ সময় কেন্দ্রিয় পরিষদে যোগদানের আহ্বান করা হলে মিঃ জিন্নাহ বড় লাটকে জানিয়ে দিলেন যে, যতদিন পর্যন্ত কেবিনেট মিশনের পরিকল্পনা কংগ্রেস না মেনে নেয় ততদিন মুসলিমরা এতে অংশ গ্রহণ করতে পারে না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মিঃ এ্যাটলী ভারতের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পার্লামেন্টে এক ভাষণে বৃটিশ সরকারের ভারত শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের সদিচ্ছা প্রকাশ করেন।
১৯৪৭ সালের ২২শে মার্চ লর্ড ওয়াভেলের স্থলে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন শেষ বড় লাটের কার্যভার গ্রহণ করেন। তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন। এ সময় জিন্নাহও মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান দাবীর প্রতি অটল মনোভাব প্রদর্শন করলে কংগ্রেস এ দাবি মেনে নেয়। কিন্তু মুসলিম লীগকে ও পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য তারা এক নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করে যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে হিন্দুু মুসলমান অধিবাসী হিসাবে ভাগ করতে হবে। কিন্তু মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, পাঞ্জাবের গভর্ণর স্যার জনকিনস, বাংলার প্রধান মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
ইতিহাস সত্যিই বিচিত্র। যে হিন্দুরা লর্ড কার্জনের বঙ্গ ভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল তারাই আবার নিজ স্বার্থে বাংলা বিভক্তি সম্পন্ন করল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭শে এপ্রিল অখ- স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বাংলার কংগ্রেসের অন্যতম অসাম্প্রদায়িক নেতা মিঃ বসু, কিরণ শঙ্কর রায়সহ আরও অনেকে এ প্রস্তাবের প্রতি সম্মতি জানান। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন ‘ হিন্দু মহাসভা’ এবং কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল অবাংগালী নেতাগণ এর বিরোধিতা শুরু করেন। ফলে পরিকল্পনাটি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারত বিভাগের নীতি ঘোষণা করেন। এক দিকে কংগ্রেস হাইকমা-ের বিরোধিতা এবং অন্যদিকে কংগ্রেস লীগের পাকিস্তান দাবি মেনে না নেয়ায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এ ভাবে বসু -সোহরাওয়ার্দীর অখ- স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়। ভাইসরয়ের পক্ষে লর্ড ইজমে জিন্নাহকে জানিয়ে দিলেন,“Ò If India was to be divided, Bengal and Panjab would also have to be split in two,`according to the will of the people. এ সব অবস্থাার প্রেক্ষপটে জিন্নাহ বলতে বাধ্য হলেন‘ Better a month- eaten Pakistan that no Pakistan at all. ‘এ ভাবেই ইতিহাসের অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ ই আগষ্ট বৃটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ( ৯-১১-১৩)